Saturday, July 10, 2010

নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে


২০০৭ সাল থেকে জার্মানির লিন্ডাও শহরে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন আমাদের তরুণ গবেষকেরা। ২০০৯ সালে রসায়নের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তিন তরুণ গবেষক। তাদের অন্যতম কাজী মাহমুদা তাসনীম বিজ্ঞান প্রজন্মের পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন তার দুর্লভ অভিজ্ঞতা।তারিখঃ ৩০-০৮-২০০৯


শুরুটা হয়েছিল কিছুটা দ্বিধা নিয়েই। মৌলিক রসায়ন নয়, প্রকৌশলের ছাত্রী আমি,তারপর ও জার্মানীর লিন্ডাও-এ রসায়নে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে অংশগ্রহনের তীব্র আকাঙ্খা থেকেই আবেদন করে ফেললাম। প্রাথমিক মনোনয়নের ধাপ পার করতে পেরে আশার আলো দ্যুতি ছড়ালো হয়তো। অধীর অপেক্ষায় চূড়ান্ত মনোনয়নের দিন গুনছি। হঠাৎ মেইল পেলাম লিন্ডাও কাউন্সিলের। তাদের শেষ মুহুর্তের মনোনয়ন এ এবার বাংলাদেশ থেকে তরুণ গবেষক হিসেবে যাচ্ছি আমরা তিনজন। আমার সাথে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশির ঘোষ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লব কুমার সাহা।

স্বপ্ন এবার সত্যি হবার পথে! কিভাবে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এগিয়ে এলেন মুনির হাসান। তাঁর মাধ্যমেই যোগাযোগ হলো শিশির ও বিপ্লবের সাথে। আমরা তিনজনই একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র বলে বন্ধুত্ব হয়াটা কেবল সময়ের ব্যপার ছিল মাত্র। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হতে যাচ্ছে – বিস্ময়ে অভিভূত এই আমাদের আলোচনায় তাই ঘুরে ফিরে সেই একই পরিকল্পনা। নর্থ আমেরিকান বাংলাদেশি ইসলামিক কমিঊনিটি ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর যৌথ অর্থায়নে নিশ্চিত হলো আমাদের বহু আকাঙ্খিত এই যাত্রা। বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আতাউল করিম দাড়াঁলেন আমাদের পাশে।

২৬শে জুন সকালে লিন্ডাও এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমাদের সাথেই ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মেসবাহ উদ্দিন আহমাদ এবং তাঁর স্ত্রী ড. ফরিদা আখতার। এদিকে উৎসাহ উদ্দীপনার সময় শেষ করে ঐ রাতেই পৌঁছলাম জার্মানির মিউনিখ শহরে। মিউনিখে বুয়েটের এক প্রাত্তন ছাত্র সুমিতের আতিথেয়তায় রাত কাটল। পরদিন বিকেলেই আমরা চলে গেলাম ছোট্ট সুন্দর নয়নাভিরাম শহর লিন্ডাও।

লিন্ডাও, ২৮শে জুন, দুপুর, পর্দা উঠলো বিজ্ঞানিদের এক মহা মিলনমেলার। ২৪ জন বিজ্ঞানিদের সাথে ৬৬ টি দেশ থেকে আসা ৫৮০ জন তরুন গবেষকদের এই সেতুবন্ধনের আয়োজনে আমরাও একই কাতারে দাঁড়িয়ে!

জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, নবায়নযোগ্য শক্তি- এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই এবারকার আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল। সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে কিভাবে প্রয়োজনীয় উৎপাদন সম্ভব- এই ব্যপারটিকেই খুব গুরুত্বের সাথে দেখেন বিজ্ঞানিরা। সম্মেলনের আয়োজনকে সাজানো হয়েছিল দুই ভাগে। নির্ধারিত চারদিনই দুপুর পর্যন্ত চলতো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানিদের লেকচার আর বক্তৃতা। আর বিকেলে ছিল তাঁদের সাথে আগ্রহী তরুন গবেষকদের আলোচনার ব্যবস্থা।
বিজ্ঞানিদের গবেষণার কথা তো আমরা জানতে পারি বই পরে, কিন্তু একজন মানুষ হিষেবে তারা কেমন এই ব্যপারেই আমার আগ্রহ ছিল বেশি। এদিক বিবেচনায় আমার ঝোক তা বরাবরই ছিল সুইস বিজ্ঞানি ড. আর্নস্ট এর প্রতি, কারন তিনি কেবল একজন বিজ্ঞানিই নন, বরং একজন দার্শনিকও বটে। বক্তৃতা পর্বের প্রথমেই পেয়েও গেলাম তাঁকে। রসায়ন নিয়ে কাজ করেন বলেই কিনা, রসবোধের আধার নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলেন তিঁনি। Fourier transform NMR spectrometer নিয়ে কাজ করে ১৯৯১ সালে নোবেল জয় করলেও তার বক্তব্যে এই দাঁত ভাঙা শব্দের চর্চা হল কমই। তিঁনি বরং তাঁর জ্ঞ্যানগর্ভ জীবনবোধের আলোয় আলোকিত করলেন আমাদের ভিন্ন মাত্রায়। বললেন, “কখনোই একপেশে পুঁথিগতবিদ্যা স্বর্বস্ব হয়োনা, কাজ করো মনের তাগিদে”।

ওজোন স্তর ক্ষতির কারন খুঁজতে খুঁজতেই ১৯৯৫ সালে নোবেল পেয়ে যাওয়া তিন বিজ্ঞানী ড. ক্রুজেন, ড. রোনাল্ড এবং ড. মোলিনার লেকচারের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। “রসায়ন অবশ্যই আমার পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল না”, শুরুতেই ক্রুজেন এর সরল স্বীকারোক্তি! কিন্তু, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকুরি শুরু করলেও গবেষণার প্রতি আসক্তি হয়ত তাঁর মজ্জাগত ছিলো। তাই পরবর্তীতে স্টকহোম ইউনিভার্সিটির আবহাওয়াবিদ্যা বিভাগে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মকালীন সময়েই তিনি মাস্টার্স, এমনকি পিএইচডি ও করে ফেললেন আবহাওয়াবিদ্যাতেই। আর এইভাবেই বায়ুমন্ডলীয় ওজোন এর আলোক-রসায়ন নিয়ে কাজ করতে করতেই নাইট্রাস আক্সাইড (N2O) কিভাবে ওজোনস্তরকে ধংস্ব করে তা ব্যখ্যা করে ফেললেন! ভূমির ব্যকটেরিয়াতে থাকা প্রাকৃতিক নাইট্রাস আক্সাইড বায়ুমন্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সৌর শক্তির উপস্থিতিতে ভেঙ্গে সক্রিয় দুটি যৌগ নাইট্রোজেন-ডাই-আক্সাইড (NO2) এবং নাইট্রিক আক্সাইড (NO) উৎপন্ন করে যা ওজোন (O3) কে ভেঙ্গে অক্সিজেন অনু(O2) তৈরী করে ফেলে। এই তথ্য বেরিয়ে আসে ক্রুজেন এর গবেষণায়। আর এরই মাধ্যমে একজন রসায়নে বীতস্রদ্ধ মানুষ রসায়নের সর্বোচ্চ পুরষ্কারে সম্মানিত হন! যুগ যুগ ধরে মানবজাতির নানবিধ কর্মকান্ডে কিভাবে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, গ্রীন হাঊজ গ্যাস, এসিড বৃষ্টির ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে- এই ব্যপার গুলোই তুলে ধরলেন ক্রুজেন তাঁর তথ্যনির্ভর বক্তব্যে। এরপর এলেন ড. রোলান্ড। কে জানতো আমেরিকার ওহাইওর আবহাওয়া ষ্টেশনে কাজ করা সামান্য এক স্বেচ্ছাসেবক একদিন পৃথিবী নামের গ্রহটাকে বাঁচাতে কিছু একটা করে ফেলবেন? আসল ঘটনা হলো, পোষ্ট ডক্তোরেট রিসার্চে তিঁনি আর ড. মোলিনা মিলিত ভাবে মাত্র তিন মাসের একটা গবেষনায় একটি থিউরী দাঁড় করিয়ে ফেললেন যা থেকে ধারণা করা যায় ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন (CFC) ওজোন স্তর ধংসের একটি অন্যতম কারন! পরবর্তিতে তাদের এই তত্ব নানাভাবে সত্যি প্রমানিত হবার পর আন্তর্জাতিকভাবে CFC কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। তাঁদের এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি মেলে ১৯৯৫ সালে নোবেল জয়ের মাধ্যমে। পরিবেশ বাঁচাতে ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধ থেকেই ধাপে ধাপে স্বর্বজনীন সুফল সম্ভব। “মানুষকে ‘লাল বাতি’ মেনে চলতে অভ্যস্ত হতে হবে”, এমন মন্তব্য ড. মোলিনার। নীতি –নির্ধারক ও বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর এক টেবিলে বসা টাকেও তিনি গুরুত্তপুর্ণ মনে করেন। সবসময়ই হাসিখুশি অমায়িক এই বিজ্ঞানির সাথে বিকেল বেলার আলোচনা পর্ব শেষে বেশকিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ পাই আমি। একমাত্র তাঁর সাথে একটা মিল খুঁজে পেয়েই যেন সন্তুষ্ট আমি - তাঁর মতো আমারও ব্যাচেলর ডিগ্রী কেমিকৌশল ইঞ্জিনিয়ারিং এ! বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগ সহ নানা বিষয়ে তিনি কথা বললেন। দেখলাম, এ বিষয়ে আমার থেকে খুব কম জানেন না ড.মোলিনা!

জৈব-রসায়নের খুব বেশি কিছু আমার জানা না থাকলেও পরবর্তী দিন গুলোতে ড. মার্টিন, ড. শিমমুরা আর ড. রজার সেইন এর লেকচার এর পর গ্রীন ফ্লোরেসেন্ট প্রোটিন (GFP) এর ব্যপারটা কিছুটা হলেও বোধগম্য হলো আমার। এই জিএফপি নিয়ে গবেষণাই তাঁদেরকে ২০০৮ সালে নোবেল পাইয়ে দেয়! জিএফপি হলো জিনগতভাবে লিখিত মার্কার যার বর্ণ সবুজ, যা কিনা খুব সহজেই মানব দেহের জীবন্ত টিস্যু থেকে দৃষ্টিগ্রাহ্য। বায়ো-মেডিকেল গবেষণার পথ ধরেই GFP এখন মানব শরীরের টিউমারও সনাক্ত করতে পারছে! বিনয়ী মার্টিন তাঁর বক্তব্যের ফাঁকেই আমাদের জানিয়ে দিলেন তাঁর এই সাফল্যের সিংহভাগই নাকি তাঁর স্ত্রী এবং একই সাথে সহকর্মী ড. টুল্লে হ্যাজেলরিগ এর উপরই বর্তায় মহতি এই মানুষ গুলোর কাছে বিনয়ী হতে পারাটা একদম শেখার মতো। এদিকে ড.রজার সেইন তাঁর জিএফপি-সংক্রান্ত আকর্ষণীয় গল্প(!) শেষে তরুণ গবেষকদের জন্য কিছু উপদেশ দিতে ভুললেন না! উপদেশ গুলোর সারাংশটা এমন- “এমন কোনো কাজ খুঁজে নাও, যা তোমাকে কিছুটা হলেও মানসিক প্রশান্তিও দেবে”, “লেবু থেকে লেবুর শরবতই বানাতে চেষ্টা করো, অন্য কিছু নয়; অধ্যবসয় কখনও বিফলে যায় না”!

খুবই কৌতুকপ্রিয় মজার মানুষ স্যার ক্রোটো! তাঁর অসাধারণ বক্তৃতার পর তো তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে! এই রকম একজন বিজ্ঞানের সাধনায় ডুবে থাকা মানুষ কিভাবে সাধারণ্যে মিশে যেতে পারেন এটা ক্রোটোকে না দেখলে বোঝা যায় না! ফুলেরিন কার্বন যৌগ ( ৬০ অথবা তার চেয়েও বেশি সংখ্যক কার্বন পরমানু নিয়ে গঠিত যৌগ) আবিষ্কার তাঁকে ১৯৯৬ সালে নোবেল পাইয়ে দিলেও তিনি কেবল একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবেই পরিচিত নন, শিক্ষা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে প্রসারিত করার জন্য নানারকম সামাজিক কর্মকান্ডেও তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত। “আমি একজন মুক্ত চিন্তার, রসিক, মানবতাবাদী মানুষ”-নিজেকে এইভাবেই প্রকাশ করেন ক্রোটো! “ আমি কখনো উত্তর খুঁজি না, বরং প্রশ্নটা বুঝতে চেষ্টা করি”, গবেষণার ব্যপারে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিটা এমনই। এই মজার মানুষটার সাথেও বেশ আন্তরিক আলাপচারিতার সৌভাগ্য হয় আমার। পরবর্তীতে আরও একবার তাঁর সাথে দেখা হলে নতুন করে পরিচয় দিতে হলো না, বরং তিনি নিজেই চিনে ফেললেন! আমি খুবই সম্মানিতবোধ করলাম! বাংলাদেশ নিয়ে তিনিও যে খুব ওয়াকিফহাল, তাঁর সাথে কথায় তা ঠিকই বোঝা গেলো!

কেবল নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সাথেই নয় পরিচয় হয় নানা দেশ থেকে আশা তরুণ গবেষকদের সাথে। জানা হয় তাদের তাদের গবেষনার বিষয় বস্তু সম্পর্কেও। এর মাঝে একদিন হঠাৎ ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ইউরোভিশন নেটওয়ার্ক এর এক সাক্ষাতকার এ আমার ডাক পড়ে! পাঁচ দেশের পাঁচ জন নারী গবেষক নিয়ে “বিজ্ঞানে নারীর অগ্রগতি” বিষয়ক এক আলোচনায় ক্যামেরার সামনে দাড়ালাম আমি। ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা! যাহোক, এই দিকে সম্মেলন এর ফাঁকেই আমি, বিপ্লব আর শিশির ঘুরে নিলাম ‘কন্সট্যান্স লেক’ এর পাশে ছোট্ট সাজানো শহর লিন্ডাও।

খুব কাছে থেকে নাকি হাতি দেখলে ঠিক আন্দাজ করা যায় না। আমার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কেমন করে কেটে গেল ২৮ জুন থেকে ৩ জুলাই সম্মেলন এর দিনগুলো! বই এর পাতা আর ওয়েবপেজ এ যাদের দেখে, যাদের গবেষণার কথা জানতে পেরেই তৃপ্ত হতে হয়, তাদেরকেই খুব কাছে থেকে দেখা হয়ে গেল, কিছুটা জানাও হয়ে গেল হয়ত! বিজ্ঞান এর গবেষণার জগতে শীর্ষে থাকা এই মানুষগুলো ব্যক্তি হিসেবে কী অসাধারণভাবে সাধারণ, কী ঊদার আর বিনয়ী, আমার এই উপলব্ধিটাই আমার লিন্ডাও অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।


Link: http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=24&date=2009-08-30

3 comments:

Anonymous said...

Nice post and this mail helped me alot in my college assignement. Thanks you for your information.

Unknown said...

Dear respected all,
I have been selected as a participant for 63rd Lindau Nobel Laureate meeting. But I am still in confusion about my travel cost sponsorship. Please suggest me what I should do in this regard.

Taslim Ur Rashid

BDNow24 said...

thank You admin for your post.

BDNow24.Com-Bangla Online News